IMG-LOGO

বাল্যবিবাহ রোধ হবেই

Last Modified: 18 November 2017

বাল্যবিবাহের ফলে ছেলে মেয়ের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সাংসারিকসহ বহু ধরনের ক্ষতি হয় এরকম প্রচার বিলবোর্ড, পোষ্টার, রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজসহ  প্রায় সর্বত্রই দেখা বা শোনা যায়। এ বিষয়ে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে সভা, কর্মশালা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন আছে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা, নির্বাচিত প্রতিনিধি, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিবাহ রেজিষ্টার, পুরোহিত, ধর্মীয় নেতা ও নাগরিক সমাজের সকল ধরনের পেশার মানুষ নিয়ে আয়োজন করা হয় সভা ও অনুষ্ঠান। কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে ঘোষিত হচ্ছে বাল্যবিবাহ মুক্ত ইউনিয়ন ও উপজেলা। এ ধারাবাহিকতায় হয়তো যেকোন  দিন বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলাও ঘোষিত হয়ে যাবে। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি নিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে এবং দেশের  মধ্যকার বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মধ্যে তূলনামূলক চিত্র গবেষকরা দিচ্ছেন নিরন্তর। অন্যান্য দেশের তূলনায় আমাদের দেশের অবস্থান খুবই হতাশাজনক। বাল্যবিবাহ বিষয়ে সরকারী আইন আগে যা ছিল ২০১৭ সালে তাকে আরও শক্ত সামর্থ্য করে পাশ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকার ব্যাখ্যা করে চলেছেন এবং ভিন্ন মতালম্বীরা সংশোধন ও সংযোজনের জন্য মতামত দিয়ে যাচ্ছেন, সমালোচনা করছেন। এরই মধ্যে কোন কোন কিশোরী-কিশোর সাহসী হয়ে নিজের এবং অন্যান্য অপ্রাপ্ত বয়সীদের বিবাহ বন্ধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশ-বিদেশের প্রসংশা এমনকি পুরস্কারও পেয়েছেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারীভাবে হট লাইন চালু আছে সাহায্যের জন্য এবং জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওসি ও অন্যান্য অফিসারদের তৎপরতার জন্য নির্দেশনা আছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। দায়িত্বশীল সরকারী কর্মকর্তাদের সেসব তৎপরতা খবরের কাগজ, টেলিভিশনসহ অন্যান্য মাধ্যমে যথেষ্টই দেখা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে সাধারণের মধ্যে বাল্যবিবাহ বিষয়ে জানাজানি বেড়েছে বেশ সেটাও বলা যায়।   

প্রশ্ন হচ্ছে- বাল্যবিবাহ রোধের অগ্রগতি কেমন? এর উত্তরে বিভিন্ন সভা, কর্মশালার আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে সাধারনত: যে মতামতগুলো শোনা যায় তা হলো- আগের চেয়ে বাল্যবিবাহ অনেক কমেছে। একদিন বা এক রাতেই তো এত বড় একটি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কেউ আক্ষেপ করে বলেন, বাল্যবিবাহ থামানোই যাচ্ছে না। এমন তথ্যও আছে, বাল্যবিবাহ মুক্ত ইউনিয়ন বা উপজেলা ঘোষনার পর পূর্বের তূলনায় বেশী সংখ্যক বাল্যবিবাহ হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো- আগে বাল্যবিবাহ হলেও তা অন্তত: রেজিষ্ট্রি হতো, সেখানে হয়তো কিছু তথ্যে গরমিল থাকেতো। কিন্তু এখন এলাকার বাইরে গিয়ে বা গোপনে যখন বিয়ে হচ্ছে তখন রেজিষ্ট্রি হয় না অথবা ভুয়া রেজিষ্ট্রি হচ্ছে। প্রয়োজনে তারা বিয়ের কথা অস্বীকার করছে। বাস্তবে তারা ঘর-সংসার করছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে সামাজিক কারনেই স্থানীয় কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে চান না। ভবিষ্যতে যদি দাম্পত্য জীবন বা সংসারে এমন কোন সমস্যা দেখা দেয়, যেখানে আইনী সহায়তা দরকার হতে পারে তখন কী হবে? বাস্তবতা এমনই কোনভাবে বিয়ে হয়ে গেলে তখন সবাই মেনে নিচ্ছেন বা মেনে নিতে হচ্ছে নানা বিবেচনায়। আইন অনুযায়ী বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করলে বর, কনে ও বাবা, মা, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তির বিধান আছে। বাস্তবে তেমন শাস্তির নজির কম। শাস্তি কিছু হচ্ছে বাল্যবিবাহের উদ্যোগ গ্রহণ করলে বা আয়োজনের জন্য, যা বিবাহ সম্পন্নের পূর্বেই। বোঝা যাচ্ছে কাঙ্খিত অগ্রগতি হচ্ছে না। তাই ভালভাবে বোঝার জন্য  পুরো বিষয়টিই বিশ্লেষণ করা বা একটু ফিরে দেখা দরকার হচ্ছে। 
কোন সমস্যা সমাধানের সাধারণ পন্থা হচ্ছে- প্রথমে সমস্যাটিকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা বা  বিবৃত করা। সমস্যাটি হচ্ছে কেন, তার কারণ ও পিছনের কারণ পর্যায়ক্রমিকভাবে নির্ণয় করে মূল কারণ বা উৎস চিহ্নিত করা। পাশাপাশি সমস্যাটি কিভাবে সংঘঠিত হচ্ছে, কত সময় ধরে হচ্ছে সেসব তথ্য জানা। প্রাপ্ত সকল তথ্যের যথাযথ বিশ্লেষণ সমস্যাটির সমাধানে করনীয় নির্ধারণে মূল সহায়ক হতে পারে।
পরিষ্কারভাবে বললে আমাদের সামনে সমস্যাটি হলো- বাল্যবিবাহ বা শিশুবিবাহ। ১৮ বছরের নিচে বয়স এমন মেয়ে ২১ বছরের নীচে ছেলের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আইনত বাল্যবিবাহ। মূলত: বাবা, মা বা অভিভাবকের মতামতে এরকম বিবাহ সংঘঠিত হচ্ছে। তাদের মতামতের সাথে অন্যান্য অনেকের প্রভাব কাজ করতে পারে। যেমন আত্মীয়-স্বজন, ঘটক, স্থানীয় প্রভাবশালী, মেয়ে বা ছেলের মতামত ইত্যাদি। বিবাহ সম্পন্ন করার সময় আরও দু’টি পক্ষ জড়িত হয় তারা হলো- বিবাহ রেজিষ্ট্রার ও মৌলবী বা মোল্লা। বাবা মা বা অভিভাবেকের বাইরে যে পক্ষগুলো আছে তাদের দু’ভাগ করা যায়। এক ভাগ হচ্ছে- আত্মীয়-স্বজন, ঘটক, স্থানীয় প্রভাবশালী, মেয়ে বা ছেলের মতামত প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। আর এক ভাগ হচ্ছে- বিবাহ রেজিষ্ট্রার ও মৌলবী বা মোল্লা। এই পক্ষ দুটি বিবাহ সম্পন্নের জন্য প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় ভাগের এ পক্ষটি কিছু অবৈধ সুযোগ, সুবিধা নিয়ে কাজটি করে এবং কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবের কাছে বাধ্য হয়ে করতে হয়। এভাবে ভুয়া বিবাহ রেজিষ্ট্রি হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাবা মা বা অভিভাবকই বাল্যবিবাহে মূল ভূমিকা পালন করছে। ব্যতিক্রম হলেও শুধু ছেলে, মেয়ের প্রনয়ের ফলে নিজেদের  মতামত বা সিদ্ধান্তে  বাবা মা বা অভিভাবকের অগোচরে অথবা পরোক্ষ সহায়তায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাবা, মা, অভিভাবক ও কখনো ছেলেমেয়ে  যারা বল্যবিবাহে মূল ভূমিকা পালন করেন তারা কেন এটা করেন? বাবা, মা ও অভিভাবকের পক্ষ হতে বলা হয়- মেয়ের একটা ভাল সম্মন্ধ পাওয়া গেল কেনই বা এটা হাত ছাড়া করি। ভাল সম্মন্ধের অর্থ হলো-ছেলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, যৌতুক লাগছে না অথবা কম লাগছে, আত্মীয়ের মধ্যেকার ছেলে ইত্যাদি। আরও বলেন, মেয়েটা  ডাগর হয়েছে, সব সময় চিন্তায় থাকি, আজ বাদে কাল তো মেয়েটাকে পর ঘর করতেই হবে, তাই আর দেরি করলাম না। এর সাথে হয়তো সামাজিক, সাংস্কৃতিক অন্যান্য কারণ জড়িত থাকতে পারে। তবে তাদের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়-মেয়েটা একটা ঝামেলা হয়ে আছে। এরকম বয়সের মেয়ের নিরাপত্তা সংকট আছে। সুতরাং ঝামেলা তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলেই ভাল। মেয়েটা যে মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠতে পারে তাদের পরিবারের জন্য তেমন কোন ভাবনা মাথায় আসেনি। যেসব মেয়ে ছেলে নিজে পছন্দ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় তারা সরাসরি ঘটনার জন্য দায়ী হলেও এখানেও বাবা, মা ও অভিভাবকের গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কোন একটি পক্ষের নীরব সমর্থন থাকে অথবা এরকম বয়সের সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা পালনে তাদের কোন না কোন ঘাটতি বা দায় অবশ্যই আছে। অপরপক্ষে মেয়ে ও ছেলের মধ্যে তেমন জীবন স্বপ্ন সৃষ্টির আগেই আবেগতাড়িত হয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।        
বাল্যবিবাহ বন্ধে চলমান সকল কর্মসূচী সম্পর্কে একটু ফিরে দেখি। এসব কর্মসূচী বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। সরকারী-বেসরকারী  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সভা, ওরিয়েন্টেশন ইত্যাদিতে প্রধানত অংশগ্রহণ করেন সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা, জন প্রতিনিধি, ধর্মীয়নেতা, বিবাহ রেজিষ্ট্রার, মৌলবী, ঘটক, মিডিয়া কর্মী ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা। বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ইত্যাদি। বড় কোন অনুষ্ঠান হলে শিক্ষার্থী থাকে তার একটি বড় অংশ। সেখানে মূলত: অনেক ভাল কথার বক্তৃতা হয়। এসব বক্তৃতায় নিশ্চয় কিছু না কিছু হচ্ছে। কিন্তু বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে মূল উদ্যোগ গ্রহণকারী বাবা, মা ও অভিভাবক কিভাবে থামবে? তাদের উপলদ্ধিবোধ কতটুকু তৈরী হচ্ছে। বক্তৃতা শুনে আমাদের দেশে লোকজন কতটা মানে বা কতটুকু কাজে লাগায়, এটা একটি বড় প্রশ্ন। সাদামাটাভাবেও বোঝা যায় বেশিরভাগই তা মানেন না। তা না হলে চারিদিকে ধর্মীয় ওয়াজ, বক্তৃতা,  নানা ধরনের সভা সমাবেশ, অনুষ্ঠানে অনেক ভাল কথা নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। সমাজে তার প্রতিফলন থাকলে দেশে এত অনাচার, অনিয়ম,  দুর্নীতি নিশ্চয় থাকতো না। বাল্যবিবাহ সংঘঠিত হওয়ার চিত্র থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে-  চলমান কর্মসূচীতে কিছু কাজ হলেও বড় ধরণের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।  
বাল্যবিবাহ রোধে দেশে আইন আছে। আইন প্রয়োগে বেশ তৎপরতাও  আছে। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। অপরাধ সংঘঠিত করা যেমন শাস্তি যোগ্য তেমনি অপরাধ সংঘঠনের উদ্দেশ্যে আলোচনা, ষড়যন্ত্র করাও শাস্তি যোগ্য। অপরাধ সংঘঠিত করার কাজে আনুসাঙ্গিক যত উপকরণ,  দ্রব্যাদি সমাবেশিত হয় এবং তার সাথে যে বা যারা সংশ্লিষ্ট তার সবকিছুই শাস্তির আওতায় আসার নিয়ম।  কিন্তু বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমরা কী দেখছি। যখন বাল্যবিবাহ সংঘঠিত হচ্ছে এমন খবর পাওয়া গেলে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, কোন কোন ক্ষেত্রে অভিভাবক, বিবাহ রেজিষ্টার ও ঘটকের শাস্তি  হচ্ছে যদিও তার সংখ্যা বেশি না। বিবাহের জন্য আলাপ আলোচনা চলছে, বিবাহের অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য সন্নিবেশিত,  দ্রব্যাদি, ডেকোরেশন ইত্যাদির জন্য কোন প্রশাসনিক বা আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের খবর জানা যায়নি। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে- প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বা কমিউনিটির কোন উদ্যোগে বিবাহ বন্ধ হওয়ার পর অন্যত্র যেয়ে বা গোপনে আবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এটা জানার পরও তাদের নামে কোন অভিাযোগ হচ্ছে না বা শাস্তি ও হচ্ছে না। এমনকি এ বিষয়টি আর আলোচনায়ও থাকছে না। তখন ব্যাপারটি এমন হয় যে, যা হবার হয়ে গেছে এখন আর কী করার আছে। এখন কিছু করলে তো ছেলে মেয়ে দুজনেরই জীবনের ক্ষতি। তাহলে বলা যায় এ অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পর তেমন কোন কার্যক্রম বা আইনী ব্যবস্থা নেই। 
আমরা জানি কোন সমস্যার সমাধানে কয়েকটি  পর্যায়ে কাজ করতে হয়। যেমন ঘটার পূর্ব, চলমান ও পরবর্তী কাজ। পর্যায়ক্রমিক ভাগ করে কাজ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পারলে নিশ্চিতভাবেই সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব হতে পারে। সমস্যার উৎস স্থলকে বিবেচনায় না নিয়ে ফলাফল কেন্দ্রিক কার্যক্রম নির্ধারণ করলে সে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয় না। তাই রোগ বিষয়ে একটি কথা আছে ‘নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ ভাল।’ রোগ হলে অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু তাই বলে অনবরত চিকিৎসার জন্য সব ব্যবস্থা করলেও রোগ হওয়া কমবে না যতক্ষণ উৎস স্থল বন্ধ হবে না।
বাল্যবিবাহে মূল ভ’মিকা পালনকারী হচ্ছে- পাত্র-পাত্রির বাবা, মা, অভিভাবক ও ছেলে, মেয়ে। সুতরাং তারাই উৎস বা মূল। এমনটি শোনা যায়নি কোথাও যে, ছেলে, মেয়ের বাবা, মা চাচ্ছে না বা ছেলে, মেয়েও নিজেরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, তারপরও বিয়ে হয়েছে। তাহলে অন্যান্য সকল পক্ষই অপ্রধান। এথেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় প্রধানত: কার্যক্রম বা কর্মসূচী নিতে হবে মূল উৎসকে কেন্দ্র করে। যেহেতু শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি তাই গ্রামাঞ্চলকে কেন্দ্র করে কর্মসূচী চালাতে হবে। 
এখন প্রশ্ন- কীরকম কর্মসূচী, কীভাবে, কত সময় ধরে চালাতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হয়, সব মানুষই তার নিজের অর্জিত জ্ঞান থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং জ্ঞান, বুদ্ধির পর্যায়ে কোন পরিবর্তন না হলে সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আশা করা যায় না। তাই লক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপলদ্ধির জন্য জ্ঞান চর্চার জনউদ্যোগ প্রয়োজন। ‘যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে জ্ঞান বৃদ্ধি করা’ এ পন্থার প্রসার ঘটেছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস এর আমল থেকে। এ যুক্তি-তর্ক জনে জনে হতে পারে, দলে দলে হতে পারে। যুক্তি-তর্কে মাথা পরিষ্কার ও শানিত হয়। গণযুক্তি-তর্কে গণমানুষ শানিত হয়। এক্ষেত্রে গণমানুষের উপর নির্ভর করতে হবে এবং মানতেই হবে তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার। অনুকূল পরিবেশে, নিয়মিত চর্চার ফলে খুলতে থাকবে সে ভান্ডার। জ্ঞান চর্চার এ পদ্ধতি বা পন্থাকে গণগবেষণা/কমিউনিটি ডায়ালগ বলা যায়। গণগবেষণা/কমিউনিটি ডায়ালগ পদ্ধতিতে কোন বক্তৃতা নেই। আছে শুধু গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন ও সঠিক তথ্য প্রদান। অন্যতম কিছু প্রশ্ন হচ্ছে- কী? কেন? কোথায়? কখন? কে? কীভাবে? ইত্যাদি। এ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীগণ নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারেন। উপলদ্ধি করতে পারেন তার অসীম সামর্থ্যকে। নিজেকে আবিষ্কার করার পর ব্যক্তি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন।  আসতে থাকে তার মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন। তখন ব্যক্তির স্বপ্ন সন্নিবেশিত হয়ে পরিবারের ও সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি হয়। গৃহীত হতে পারে সম্মিলিত উদ্যোগ। সে উদ্যোগ ছোট সমাজ থেকে বড় সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জনসাধারণের মধ্যে দলে গণগবেষণা/কমিউনিটি ডায়ালগ এর কাজে সহায়তা করার জন্য সহায়ক/এনিমেটর হিসেবে কাজ করতে পারেন স্থানীয় লেখাপড়া জানা যুব সমাজের মধ্যেকার উপযোগী নারী, পুরুষ। তাদেরকে কয়েকদিনের কর্মশালার মাধ্যমে সহায়ক/এনিমেটর হিসেবে উপযোগী করে দায়িত্ব দিতে হবে। জনসাধারণের জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হতে পারে গ্রামাঞ্চলের কমিউনিটিভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ। কারণ মা, বাবা ও অভিভাবক কমিউনিটিতে থাকলে কিশোর-কিশোরীদের বড় একটি অংশ থাকে বিদ্যালয় ও কলেজে। গণগবেষণা/ডায়ালগ এর সময় এক-দেড় ঘন্টা। প্রতিদিন বা সপ্তাহে ২/৩ দিন চলতে পারে। এটা নির্ভর করবে অংশগ্রহণকারীদের পেশা, সময়-সুযোগ বিবেচনার উপর। এ কার্যক্রমে এনিমেটরের সহায়তা দরকার কমপক্ষে ৬/৭ মাস। তারপর স্বয়ংক্রিভাবেই এ কার্যক্রম চলতে থাকবে। নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি হবে। উদ্যোগ বিবেচনা করে সহায়তা করা দরকার হবে। তখন পরিবার, সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিশু অধিকার, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে যাবে আপনা থেকেই। সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে উদ্যোগী জনগোষ্ঠী। 
পাশাপাশি যথাযথভাবে আইন বাস্তবায়নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আইন প্রয়োগকারী সকল সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রযোজনীয় কর্মসূচী থাকতে হবে। মনে রাখা দরকার শিশু অধিকারসহ সকল জন-অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালনকারী সরকার। সুতরাং সরকারী কর্মসূচীর সাথে কার্যকর সমন্বয়ে সাফল্য বেগবান হবে।  
আলোচিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে। অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে দক্ষ সহায়ক/এনিমেটর  প্রস্তুত করা। কারণ সহায়ক/এনিমেটরের যথাযথ ভূমিকা পালন প্রকল্পের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখবে। আর একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-যে প্রতিষ্ঠান বা যারা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবেন তাদের মধ্যে বিষয়টির ধারনাগত দিকসমূহ পরিষ্কার থাকতে হবে, উপলদ্ধিতে থাকতে হবে এবং নিজেদের মধ্যেও তার অনুশীলন থাকতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাথে সকল কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা। তাহলে নিজে বদলানোর পাশাপাশি অন্যের বদলানোতে সহায়তা করা যাবে। এরকম দৃষ্টিতে কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলে “বাল্যবিবাহ মুক্ত ইউনিয়ন” না হয়ে ঘোষিত হবে “শিশু অধিকার সুরক্ষিত ইউনিয়ন” বা অন্য কিছু। তখন সব অধিকার নিয়ে শিশু বড় হবে। তারাই বদলে দেবে দেশ ও বিশ্বকে।

আলাউদ্দিন আলী, নির্বাহী পরিচালক
ইউএসএস, নীলফামারী। E-mail: uss.nilphamari@gmail.com
০৯/১১/২০১৭